নিজস্ব প্রতিবেদক : সুদানের পরিস্থিতি দিন দিন খারাপ হচ্ছে। দেশটিতে ক্ষমতার দ্বন্দ্বে গত ১৫ এপ্রিল থেকে সশস্ত্র সংঘাত চলছে। সেনাবাহিনী ও আধা সামরিক বাহিনীর মধ্যে এ সংঘাতে এর মধ্যে অনেক মানুষের মৃত্যু হয়েছে। দেশটিতে চরম অস্থিরতা বিরাজ করছে। এ পরিস্থিতিতে সুদানে বসবাসরত বিভিন্ন দেশের মানুষ আতঙ্কে দিন পার করছেন।
দেশটিতে বাংলাদেশের দেড় হাজারেরও বেশি নাগরিক বসবাস করছেন। দেশের অপেক্ষায় বাংলাদেশের নাগরিকরা। এর মধ্যে সুদানের খার্তুমে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসও সশস্ত্র সংঘাতের মধ্যে পড়েছে। তবে কোন হতাহতের ঘটনা ঘটেনি।
চলমান সংকটে দেশটির সঙ্গে বিভিন্ন দেশের বাণিজ্যিক খাত বিশেষ করে আমদানি রপ্তানি বিষয়েও শঙ্কা দেখা দিয়েছে। সুদান থেকে তুলা আমদানি করে বাংলাদেশ। সুদান তুলা আমদানিকারক দেশের একটি। যদিও দেশটি থেকে বাংলাদেশের আমদানির চাহিদার খুব অল্প পরিমান তুলা আমদানি করা হয় তারপরও দেশটিতে এই সংঘাতের কারণে তুলা আমদানিতে প্রভাব পড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
তবে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বলছে, সুদানের চলমান সংকটে দেশটি থেকে বাংলাদেশের তুলা আমদানিতে কোনো বড় ধরনের প্রভাব পড়বে না। কারণ সুদান থেকে চাহিদার মোট ৬ শতাংশ আমদানি করা হয়। তারপরও এই ৬ শতাংশ ঘাটতি মেটাতে আফ্রিকান বাজারগুলোর সঙ্গে এরইমধ্যে সরকার আলোচনা শুরু করেছে। স্থানীয় আমদানিকারক ও মিলাররা বিকল্প বাজার দেখছেন।
তুলা উন্নয়ন বোর্ডের (সিডিবি) হিসাব অনুযায়ী , দেশে তুলার বার্ষিক চাহিদা ৭৩-৭৪ লাখ বেল। এর মধ্যে দেশে উৎপাদন হচ্ছে মাত্র ১ লাখ ৭১ হাজার বেল। ফলে চাহিদার বিপরীতে ঘাটতি থাকা ৭১ লাখ বেল আমদানি করতে হচ্ছে। তুলা আমদানিতে বাংলাদেশের নির্ভরতা ভারতের ওপরই সবচেয়ে বেশি। ভারত থেকে ১৯ -২৬ শতাংশ তুলা আমদানি করা হয়ে থাকে। সিডিবি বলছে, তুলার আমদানি নির্ভরতা কমাতে ২০৪১ সালের মধ্যে ২০ লাখ বেল তুলা উৎপাদনের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে।
বিটিএমএর অতিরিক্ত পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মনসুর আহমেদ বলেন, আফ্রিকান বেনিন , লেসোথো, চাদ এবং সুদানের মতো দেশগুলো বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ উৎস। এসব দেশ থেকে তুলা আমদানির হার ৪০ শতাংশ। তবে সুদান থেকে আমদানি হয় মাত্র ৫-৬ শতাংশ। তিনি বলেন, ফলে সুদানের এই ঘটনায় আমাদের কোনো নেতিবাচক প্রভাব পড়বে না।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও সুদানের বাংলাদেশ দূতাবাস সূত্র জানিয়েছে, সুদান থেকে নিরাপদে বাংলাদেশি নাগরিকদের ফিরিয়ে আনতে কাজ করছে তারা। দেশটিতে অবস্থানকারী ৭ শতাধিক বাংলাদেশি ইতোমধ্যে নিবন্ধন করেছেন। তাদের আগামী মঙ্গলবার খার্তুম থেকে নিয়ে আসা হবে। সৌদি আরব হয়ে তারা দেশে ফিরবেন।
ৎ
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, সৌদি আরবসহ কয়েকটি দেশ তাদের নাগরিকদের সরিয়ে আনতে কাজ করছে। এরমধ্যে সৌদি আরব শুধু নিজেদের দেশের নাগরিকদেরই নয়, বাংলাদেশসহ অন্যান্য দেশের নাগরিকদেরও ফিরিয়ে আনতে সহযোগিতা করছে এবং বিপদগ্রস্ত বিদেশি নাগরিকদের সহযোগিতা করছে।
গতকাল শুক্রবার সৌদি আরবের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক টুইট বার্তায় জানিয়েছে, গত ২৩ এপ্রিল তারা বাংলাদেশিসহ ১০টি দেশের ৯১জন নাগরিককে উদ্ধার করেছে। টুইটার পোস্টে বলা হয়, উদ্ধারের পর তাদের সৌদি আরবে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
সৌদির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তাদের টুইটারের দেওয়া বিবৃতিতে বলেছে, রাজতন্ত্রের নেতৃবৃন্দের নির্দেশে চলমান উদ্ধার কার্যক্রমের অংশ হিসেবে সুদান থেকে উদ্ধারকৃতরা আজ শুক্রবার জেদ্দায় পৌঁছেছেন। তাদের মধ্যে বাংলাদেশ, যুক্তরাজ্য, দক্ষিণ আফ্রিকা, নাইজেরিয়া, লিবিয়া, কানাডা এবং গিনির ৫২ জন নাগরিক রয়েছেন। তাদের আল জুবাইদ জাহাজে করে নিয়ে আসা হয়েছে। উদ্ধারকৃতদের নিজ দেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হচ্ছে।
তারা জানিয়েছে, সুদান থেকে এ পর্যন্ত সৌদি আরব ২ হাজার ৭৯৬ জনকে উদ্ধার করেছে। এরমধ্যে ১১৯ জন সৌদির নাগরিক । বাকি ২ হাজার ৬৭৭ জন ৭৮টি ভিন্ন দেশের নাগরিক।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, সৌদি আরব বাংলাদেশিদের উদ্ধারে সহযোগিতা করছে। তারা সৌদি আরব হয়ে বাংলাদেশে ফিরবেন। এছাড়া সুদান থেকে দেশে ফেরার জন্য এ পর্যন্ত ৭’শর বেশি বাংলাদেশি নাগরিক নিবন্ধন করেছেন। এদের দেশে ফিরিয়ে আনতে সৌদি সরকারের সহায়তা চাওয়া হয়েছে। সৌদি আরব সহায়তা দেবে বলে জানিয়েছে।
সুদানে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত তারেক আহমেদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, বাংলাদেশি নাগরিকদের নিরাপদে দেশে ফিরিয়ে নিতে আমরা কাজ করছি। নিবন্ধন করা হচ্ছে। প্রাথমিকভাবে আমরা আগামী ২ মে (মঙ্গলবার) প্রথম দলটিকে পাঠানোর চেষ্টা করছি। এ ক্ষেত্রে হয়তো ২/১ দিন পেছাতে পারে। কারণ যে জাহাজে করে তাদের পোর্ট সুদান থেকে পোর্ট জেদ্দায় নিয়ে যাওয়া হবে সেই জাহাজের শিডিউল এখনও চূড়ান্ত করা হয়নি। বিষয়টি সৌদি দূতাবাস থেকে চূড়ান্ত করা হবে।
এদিকে দেশের বিভিন্ন গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সুদানে বসবাসকারী বাংলাদেশি নাগরিকদের ওপর হামলা ও তাদের মালামাল লুট পাটের খবর ও ভিডিও প্রচার হচ্ছে। তাদের আতঙ্কের খবরও প্রকাশ করা হচ্ছে। এ বিষয়ে তারেক আহমেদ বলেন, এই পরিস্থিতিতে শুধু বাংলাদেশ নয়, সব দেশের নাগরিকরাই আতঙ্কে রয়েছেন। আমরা হটলাইন চালু করেছি। তবে যুদ্ধের কারণে কোনো হতাহতের ঘটনা ঘটেনি। একটা কারখানায় হামলার ঘটনায় দু-একজন আহত হয়েছেন।
সৌদি আরবে নিযুক্ত বাংলাদেশি রাষ্ট্রদূত ড. জাবেদ পাটোয়ারি বলেন, সুদানে আটকে পড়া বাংলাদেশিদের উদ্ধার করে সৌদি আরবে নিয়ে আসা হচ্ছে। এ পর্যন্ত ৬জনকে নিয়ে আসা হয়েছে। সুদানে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে আলোচনা হচ্ছে। সৌদি আরবে আসার সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশি নাগরিকদের দেশে পাঠানোর চেষ্টা করা হবে।
প্রসঙ্গত, গত ১৫ এপ্রিল সুদানের সেনাবাহিনী ও প্যারামিলিটারি র্যাপিট সাপোর্ট ফোর্সের (আরএসএফ) মধ্যে সংঘর্ষ শুরু হয়। এ পর্যন্ত দুই বাহিনীর সশস্ত্র সংঘর্ষে অন্তত ৫০০ জনের প্রাণহানি ঘটে। আহত হয়েছেন ৪ হাজারের বেশি।
এই সংঘর্ষ ও গোলাগুলিতে খার্তুমের বাংলাদেশ দূতাবাস আক্রান্ত হয়। সেখানে বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূত তারেক আহমেদের বাসায়ও গুলির ঘটনা ঘটে। তিনি বর্তমানে জাজিরা প্রদেশের মাদানি শহরে অবস্থান করছেন। সেখানে থেকেই তিনি বাংলাদেশিদের সরিয়ে নিতে কাজ করছেন।