কর্ণফুলী নদী, দশ হাজার বছরের পুরনো ঐতিহাসিক নদী। মধ্যযুগীয় পুঁথিতে নদীটিকে কাঁইচা খাল লিখা হয়েছে, মার্মা উপজাতিদের কাছে নদীটির নাম কান্সা খিওং এবং মিজোরামে কর্ণফুলীর নাম খাওৎলাং তুইপুই।
প্রাচীন চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী নদীর নাম কর্ণফুলী। হাজার হাজার বছরের ইতিহাসের অমর সাক্ষী এই নদী। পূর্ব পাহাড় থেকে শুরু হয়ে বিস্তীর্ণ পশ্চিম পাশে গড়িয়ে গড়িয়ে বঙ্গোপসাগরের সাথে মিলে গেছে এই নদী।
ভারতের মিজোরামের মমিত জেলার শৈতা গ্রাম (লুসাই পাহাড়) থেকে নেমে সুদীর্ঘ ৩২০ কিলোমিটার পথ বয়ে কর্ণফুলী নদী মিশেছে বঙ্গোপসাগরে।
বাংলাদেশের অংশের প্রায় ১৬১ কিলোমিটার পথচলা এই নদীর দুই পাশে হাজারো বর্ণিল দৃশ্য চোখে পড়ে সকলেরই। কর্ণফুলী নদীর পরিচিতি নম্বর ‘পূর্ব-পাহাড়ি অঞ্চলের নদী নং ০৩’।
কর্ণফুলীর দুই তীরের প্রাকৃতিক দৃশ্য এক কোথায় অসাধারণ। যে কারও চোখ জুড়াবেই। কর্ণফুলীর ওপরে গড়ে উঠেছে বাংলাদেশের একমাত্র জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র।
কর্ণফুলীর তীরে গড়ে উঠেছে বার আউলিয়ার পুণ্যভূমি, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি চট্টগ্রাম। চট্টগ্রামের এই সৌন্দর্যের অন্যতম প্রধান কারণ হলো কর্ণফুলী।
প্রাক ইসলামিক যুগে আরব বণিকেরা ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জের সাথে ব্যবসাবাণিজ্যের প্রধান কেন্দ্র হিসেবে যে বন্দর ব্যবহার করত, তা ছিল কর্ণফুলী মোহনার চট্টগ্রাম বন্দর।
তাই সে সময়ের বিখ্যাত কবি ইমরুল কায়েস তার একটি কসিদায় ‘করণফুল’-এর নাম উল্লেখ করেছেন। কর্ণফুলীকে নিয়ে অনেক গান রচিত হয়েছে। তার সিংহভাগ কৃতিত্ব শেফালী ঘোষের।
যত দিন চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষা বেঁচে থাকবে, তত দিন চট্টগ্রামের মানুষের মুখে মুখে বেঁচে থাকবেন শেফালী ঘোষ। তাঁর ‘ওরে সাম্পানওয়ালা’, ‘কর্ণফুলীরে সাক্ষী রাহির তোয়ারে’-এর মতো গানগুলো সত্যি অমর হয়ে রবে।
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর কবিতায় লিখেছেন “ওগো ও কর্ণফুলী, তোমার সলিলে পড়েছিল কবে কার কানফুল খুলি, তোমার স্রোতের উজান ঠেলিয়া কোন তরুণী, কে জানে সাম্পান নায়ে ফিরেছিল তার দয়িতের সন্ধানে “।
কবি আলাউদ্দিন আল আজাদ ১৯৬২ সালে রচনা করেন তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস ‘কর্ণফুলী’। এছাড়া চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় ও লোকসংস্কৃতিতে এই নদীর প্রভাব অনেক ।
কর্ণফুলী নদী-র নামকরণ
কর্ণফুলীর নামকরণ নিয়ে নানা মুনির নানা মত। তবে সবচেয়ে প্রসিদ্ধ গল্পটা চমকপ্রদ। আরাকান রাজার মেয়ে প্রেমে পড়ে এক পাহাড়ি রাজপুত্র। কোনো এক রুপালি পূর্ণিমা রাতে তারা বের হয় নৌকাভ্রমণে।
ঢেউয়ের সঙ্গে জোছনার জলকেলি রাজকন্যাকে আপ্লুত করে দেয়। ঘোরের মাঝে অসাবধানতাবশত হঠাৎ রাজকন্যার কান থেকে কানফুল খুলে নদীতে পড়ে যায়৷
এই কানফুলটি তাদের ভালোবাসার নিদর্শন হিসেবে এত দিন যত্নআত্তিতে রেখেছিল রাজকন্যা।