নিজস্ব প্রতিবেদক: জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক সম্মেলন কপ ২৯ (কনফারেন্স অব দ্য পার্টিজ) সম্মেলন শুরুর প্রথম দিনে প্যারিস চুক্তির আলোকে জলবায়ু অর্থায়নের জোর দাবি করেছেন অংশীজনরা। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোতে যেন অর্থ সহায়তা বাড়ানো হয় সেই দাবিও জানানো হয়েছে সম্মেলনে। সোমবার (১১নভেম্বর) আজারবাইজানের রাজধানী বাকুতে শুরু হওয়া কপ সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ইউএন এনভায়রনমেন্ট প্রোগ্রামের (ইউএনইপি) একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলোর শুধুমাত্র ১.৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার সঙ্গে আজকের চরম আবহাওয়ার প্রভাব মোকাবেলা করতে প্রতিদিন প্রায় এক বিলিয়ন ডলার প্রয়োজন। ক্ষতিপূরণ হিসেবে যা পাওয়া যাচ্ছে তা অপ্রতুল।
এবারের জলবায়ু সম্মেলনের প্রধান আলোচ্য বিষয় হলো- অর্থায়ন, বিশেষ করে জাতিসংঘের নতুন ‘নিউ কালেকটিভ কোয়ান্টিফাইড গোল’ (এনসিকিউজি) লক্ষ্যটি চূড়ান্ত করা। উন্নয়নশীল দেশগুলো এই লক্ষ্য চূড়ান্ত হওয়ার জন্য অপেক্ষা করছে, তাই সম্মেলনে অর্থায়নকে শীর্ষ এজেন্ডা হিসেবে রাখা হয়েছে। বলা হচ্ছে, এবারের কনফারেন্স অব দ্য পার্টি (কপ) হচ্ছে অর্থায়নের কপ। তবে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিন পিংসহ বিশ্ব নেতাদের অনেকে সম্মেলনে না আসার বিষয়টি জলবায়ু সংকট মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থায়ন পূরণে শঙ্কা তৈরি করেছে।
অন্যদিকে প্রশান্ত মহাসাগরীয় দেশ পাপুয়া নিউগিনি এবারের জলবায়ু সম্মেলন বয়কট করেছে। সম্মেলনে জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বলেছেন, জলবায়ু সংকট থেকে উত্তরণের উপায় খুঁজে বের করতে হবে। এ বিষয়ে এখনই গুরুত্ব দেওয়ার প্রকৃত সময়। অভিযোজন তহবিল প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম পড়ছে, তখন এই সমস্ত জীবাশ্ম জ্বালানির উদ্যোক্তারা মুনাফার পেছনে ছুটছে।
জাতিসংঘের জলবায়ু প্রধান সাইমন স্টিয়েল উদ্বোধনী প্লেনারিতে তার দেওয়া বক্তব্যে বলেন, তিনি স্টিয়েল গ্রেনাডা দ্বীপের ক্যারিয়াকাউ থেকে এসেছেন, যা জুলাই মাসে হারিকেন বেরিল দ্বারা বিধ্বস্ত হয়েছিল। তিনি একটি বয়স্ক প্রতিবেশী, ফ্লোরেন্সের সঙ্গে দাঁড়িয়ে থাকা নিজের একটি ছবি দেখিয়েছিলেন, যার বাড়ি ঝড়ে পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। জাতিসংঘের আলোচনা ফ্লোরেন্সের মতো মানুষের ক্ষতি করে এমন পরিবেশগত বিপর্যয় থেকে দূরে অনুভব করতে পারে তবুও জলবায়ু সংকট বিশ্বের প্রতিটি একক ব্যক্তিকে কোনো না কোনোভাবে প্রভাবিত করছে, জ্বালানী শক্তির বিল বাড়িয়ে দিচ্ছে, বৈশ্বিক অস্থিতিশীলতাকে আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে এবং জীবন কেড়ে নিচ্ছে।
কপ ২৯ -এ প্রধান অগ্রাধিকারগুলোর মধ্যে একটি নতুন বৈশ্বিক আর্থিক লক্ষ্য নির্ধারণ করা হবে, কার্বন বাজারের নিয়মগুলো চূড়ান্ত করা হবে এবং গ্রহ-সতর্কতা দূষণ কমানোর প্রতিশ্রুতি দেওয়া হবে বলে জানান তিনি।এদিকে সংবাদ সম্মেলনে জলবায়ু এনজিও অয়েল চেঞ্জ ইন্টারন্যাশনালের সহ-ব্যবস্থাপক অ্যালি রোজেনব্লুথ বলেন, জলবায়ু আন্দোলনের জন্য যুক্তরাষ্ট্রে ডোনাল্ড ট্রাম্পের পুনঃনির্বাচন ‘ভয়াবহ’ সংবাদ। ট্রাম্প তার প্রথম মেয়াদে কয়েক ডজন পরিবেশগত বিধি প্রত্যাহার করেছিলেন।
তিনি প্যারিস জলবায়ু চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে বের করে নিয়েছিলেন- যা তিনি আবার করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। ট্রাম্পের আসন্ন ভূমিকা মার্কিন জলবায়ু কর্ম পরিকল্পনা এবং জলবায়ু অর্থায়নের প্রতিশ্রুতিতে একটি বড় বাধা সৃষ্টি করতে পারে।বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব রোধে জরুরি পদক্ষেপ না নিলে ২০৫০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের প্রায় দুই কোটি মানুষ তাদের বর্তমান আবাসস্থল থেকে স্থানান্তরিত হবে এবং ২০৮০ সালের মধ্যে দেশটির ১৩ শতাংশ উপকূলীয় এলাকা সমুদ্রের পানির নিচে হারিয়ে যেতে পারে।
কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, শিল্পোন্নত দেশগুলো প্রতিশ্রুতি দিয়েছে ২০২৫ সাল পর্যন্ত প্রতি বছর ১০০ বিলিয়ন ডলার প্রদান করার জন্য। কিন্তু তারা তাদের কথা রাখেনি ২০১৫ সাল থেকে দেশটি গ্রীন ক্লাইমেট ফান্ড থেকে মাত্র ১৩ বিলিয়ন ডলার পেয়েছে। ২০২০ থেকে ২০৩০ সাল পর্যন্ত প্রতি বছর ২০ বিলিয়ন ডলার প্রয়োজন হলেও এই বছর পর্যন্ত বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক উৎস থেকে মাত্র ৭১০ মিলিয়ন ডলার পেয়েছে, যা প্যারিস কপে প্রতিশ্রুতিকৃত অর্থের মাত্র ২ থেকে ৩ শতাংশ।
জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশনের সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারণী সংস্থা হলো কনফারেন্স অব দ্য পার্টিজ (কপ)। ১৯৯২ সালে রিও সম্মেলনে ইউএনএফসিসিসি গঠনের পর থেকে প্রতি বছর কপের বার্ষিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলা প্রতিক্রিয়ার অগ্রগতি যাচাই করা হয়, গ্রীন হাউজ গ্যাস নিঃসরণ কমানোর প্রতিশ্রুতি নিয়ে আলোচনা করা হয়। এই সম্মেলনগুলো প্রত্যেকটা দেশকে এক ছাদের নিচে নিয়ে আসে। ১৯৯৫ সালের ২ মার্চ থেকে ৭ এপ্রিল জার্মানির বার্লিনে প্রথম কপ-১ কনফারেন্সটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল যেখানে বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় যৌথ উদ্যোগের বিষয়ে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছিল।
জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় কপ-২১ সম্মেলনটিতে ১৯৬টি দেশের মতামতের ভিত্তিতে প্যারিস চুক্তির সুপারিশ হয়। ওই চুক্তিতে বৈশ্বিক উষ্ণতা ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার বিষয়ে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ২০৩০ সালে গ্রিন হাউজ গ্যাস নির্গমন প্রায় ৪৩ শতাংশ কমাতে হবে এবং ২০৫০ সালের মধ্যে কীভাবে কার্বন নির্গমন শূন্যের কোঠায় নেওয়া যায় সেই বিষয় আলোচনায় স্থান পায়। তারই ধারাবাহিকতায় দুবাইতে ঐতিহাসিক কপ ২৮ এ আমরা লস এন্ড ড্যামেজ ফান্ডের আশ্বাস পেয়েছে, যেটি থেকে ২০২৬ সাল নাগাদ ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোতে অর্থায়ন করা হবে।