কালুরঘাট সেতু, চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর ওপর প্রায় ১০০ বছর আগে নির্মিত প্রথম সেতু। স্থানীয়ভাবে অনেকের কাছে ‘হালুরঘাডর পোল ’ হিসাবে অধিকতর পরিচিত।
কালুরঘাট সেতু বা ব্রীজ হলো বাংলাদেশের চট্টগ্রামের শহরের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত কর্ণফুলী নদীর উপর স্থাপিত একটি লৌহ নির্মিত সেতু।
এটি চট্টগ্রামের অন্যতম দর্শনীয় এবং ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসাবে সবার কাছে পরিচিত।
কর্ণফুলী নদীর ওপর নির্মিত এই স্থাপনাটি একটি ঐতিহাসিক নিদর্শন হিসাবেও বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে বার্মা ফ্রন্টে ব্রিটিশরা সৈন্য আনা-নেওয়ার আনা-নেওয়ার কাজে ব্যবহারের জন্য ১৯১৪ সালে কর্ণফুলী নদীর ওপর কালুরঘাট রেলসেতুটি নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয়। তবে, ১৯৩০ সালে এটির নির্মাণকাজ শেষ হয়।
ট্রেন চলাচলের জন্য ৭শ গজ লম্বা সেতুটি সে বছর ৪ জুন উদ্বোধন করা হয়।
পরে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পুনরায় বার্মা ফ্রন্টের যুদ্ধে মোটরযান চলাচলের জন্য ডেক বসানো হয়।
দেশ বিভাগের পর ডেক তুলে ফেলা হয়। পরে ১৯৫৮ সালে সব রকম যানবাহন চলাচল যোগ্য করে সেতুটির বর্তমান রূপ দেওয়া হয়।
১৯৭১-এ সেতুটির উত্তর ও পশ্চিম পাশে ঘাঁটি করে হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিল মুক্তিবাহিনী। ৯০ বছর বয়সী মেয়াদোত্তীর্ণ সেতুটির এখন মরণদশা।
তবু ঝুঁকি ও ভোগান্তি মাথায় নিয়ে দিনে প্রায় ১ লাখ লোক এই সেতু ব্যবহার করে যাচ্ছে।
চট্টগ্রামের বোয়ালখালী, পূর্ব পটিয়া, দক্ষিণ রাঙ্গুনিয়া, শহরের চান্দগাঁও ও মোহরা এলাকার প্রায় ২০ লাখ মানুষ এই সেতুর ওপর নির্ভরশীল।
কালুরঘাট সেতুর পশ্চিম পাশ (শহর এলাকা) থেকে বোয়ালখালী সদর গোমদন্ডির দূরত্ব প্রায় তিন কিলোমিটার।
কিন্তু ১০ মিনিটের এই পথ যেতে এখন সময় লাগে এক থেকে দেড় ঘণ্টা। সেতুতে ওঠার জন্য সব সময় দুদিকে গাড়ির দীর্ঘ সারি থাকে।
ব্রিটিশ আমলে নির্মিত এই কালুরঘাট সেতু দক্ষিণ চট্টগ্রামের মানুষের সাথে, চট্টগ্রাম শহর অঞ্চলের মানুষের অন্তরে নিরন্তর বন্ধন সৃষ্টি করেছে।
বলতে গেলে কেবল চট্টগ্রাম শহর নয়, এই অঞ্চলের সাথে দেশের প্রায় সমগ্র অঞ্চলের সংযোগ স্থাপন হয়েছে।
কিন্তু এই সেতু এই অঞ্চলের মানুষের কাছে, এককালে যেমনই আর্শীবাদ হিসাবে ছিল, ঠিক তেমনই এইকালে এই এলাকার মানুষের কাছে অভিশাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ায় রেলওয়ে সেতুটিকে ২০০১ সালে ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করে।
এরপর ২০১১ সালে চট্টগ্রাম বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) একদল গবেষকও এটিকে ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা দেয়।
সেতুর পূর্বপাশে দুটি সাইনবোর্ড দিয়েছে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ।
একটিতে লেখা ‘১০ টনের অধিক মালামাল পরিবহন নিষেধ।’ অপরটিতে লেখা, ‘এই সেতুর ওপর দিয়ে সাধারণ মানুষের চলাচল নিষেধ। আদেশ অমান্যকারীকে ফৌজদারিতে সোপর্দ করা হবে।’
এই সেতু দিয়ে প্রতিদিন একটি যাত্রীবাহী ট্রেন চট্টগ্রাম থেকে দোহাজারী পর্যন্ত দুবার করে যাওয়া–আসা করে।
এ ছাড়া দোহাজারী বিদ্যুৎকেন্দ্রের তেল পরিবহন করে অপর একটি মালবাহী ট্রেন।
বৃটিশ আমলে নির্মিত ব্রিজটির রয়েছে ২টি এব্যাটমেট, ৬টি ব্রিক পিলার, ১২টি স্টীল পিলার ও ১৯টি স্প্যান। জরাজীর্ণ সেতুটির বয়স এখন ৯০ বছর।
কেমন আছে শত বছরের পুরনো কালুরঘাট সেতু
বয়সের ভার আর বিপুল যানবাহনের চাপে ক্রমশ নুয়ে পড়া একমুখী ‘কালুরঘাট সেতু’ দীর্ঘসময় ধরে দক্ষিণ চট্টগ্রামের একাংশের জনগণের বহুমুখী দুর্ভোগে পরিণত হয়েছে।
রেল সেতুটির স্থানে স্থানে ছোট–বড় গর্ত। কোথাও হাড়গোড় উঠে গেছে। গর্তে ট্রাক পড়লে ঝাঁকুনি দিয়ে কেঁপে ওঠে পুরো সেতু।
সেতুতে ক্ষত এত ভয়াবহ যে গর্তের ভেতর থেকে নদীর পানি দেখা যায়। এ সেতু বারবার সংস্কার-মেরামত করে জোড়াতালি দিয়ে টিকিয়ে রাখা হয়েছে।
২০০৪ সালের ১৩ আগস্ট ১০ কোটি টাকা ব্যয়ে এই সেতুতে বড় ধরনের সংস্কার কাজ করা হয়। এ সময় ১১ মাস সেতুর ওপর যানবাহন চলাচল বন্ধ ছিল।
২০১৮ সালে জাহাজের ধাক্কায় একটি স্প্যান সরে যায়। ওই সময় দুদিন বন্ধ রেখে তা ৫০ লাখ টাকায় মেরামত করা হয়।
এর আগে একাধিক দফায় সেতুর সংস্কার করা হয়।
প্রকৌশলীদের মত, ‘লোহার সেতু ৬০ বছরে বেশি ব্যবহার করা ঠিক নয়। তারপরও আমরা এখনো ব্যবহার করছি।’
নতুন সেতু হবে কবে?
কালুরঘাট সেতু ২০০১ সালে ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করে বাংলাদেশ রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ।
এরপর থেকেই সেতু ব্যবহারকারী বোয়ালখালী উপজেলা ও পটিয়ার একাংশের বাসিন্দাদের দাবি ছিল একই স্থানে নতুন সেতু নির্মাণের।
এ ব্যাপারে আশ্বাসও মেলে। কিন্তু সেতু আর হয়নি।
অন্যদিকে, নব্বইয়ের দশকের শুরুতে দেশ গণতন্ত্রের পথে যাত্রা শুরুর পর ১৯৯১ সালে প্রথম সংসদ নির্বাচন থেকে কালুরঘাট সেতুর বিষয়টি রাজনৈতিক দল নির্বিশেষে প্রার্থীদের প্রচারণা ও প্রতিশ্রুতিতে গুরুত্ব পেয়ে আসছে।
পরবর্তী সব সংসদ নির্বাচনেও ছিল একই প্রতিশ্রুতি।
তবে, নানা জটিলতার পর চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর উপর অবশেষে নির্মিত হচ্ছে প্রস্তাবিত নতুন কালুরঘাট সেতু।
এ লক্ষ্যে ২০২০ সালের ৭ই অক্টোবর সকালে পরিদর্শনে আসছেন রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন।
সূত্রমতে, কর্ণফুলী নদীর উপর বৃটিশ আমলে নির্মিত কালুরঘাট সেতুটি ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় নতুন সেতু নির্মাণের উদ্যোগ নেয় রেলওয়ে পূর্বাঞ্চল।
সেতুটি সড়ক কাম রেলসেতু নির্মাণের নকশাও প্রণয়ন করা হয়। যার উচ্চতা নদীপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৮ মিটার ধরা হয়।
কিন্তু তাতে আপত্তি তুলে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)।
বিআইডব্লিউটিএ’র মতে নদীর নেভিগেশন চ্যানেল ঠিক রাখার জন্য সেতুর উচ্চতা ১২.২ মিটার করার শর্ত দেয়া হয়।
যা কখনোই সম্ভব নয় বলে জানানো হয় রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ থেকে।
অন্যদিকে সেতুর উচ্চতায় কোনো রকম ছাড় দেয়ার সুযোগ নেই বলে জানানো হয় বিআইডব্লিউটিএ থেকে। ফলে এ নিয়ে চরম জটিলতা সৃষ্টি হয়।
কালুরঘাট ব্রিজের উচ্চতা বাড়ানোর দাবি
চট্টগ্রাম বন্দরের নিরাপত্তা ও জাহাজ চলাচলের সুবিধার্থে কর্ণফুলী নদীর কালুরঘাটে হতে যাওয়া রেল ও সড়ক সেতুটি প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণি করার দাবি জানিয়েছে বিআইডব্লিউটিএ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সংস্থা।
নৌ বা সমুদ্রবন্দরের নিকটবর্তী নদীতে সেতু নির্মাণে পানির স্তর থেকে সর্বনিম্ন উচ্চতা হতে হবে ৪০ থেকে ৬০ ফুট।
না হলে ব্যাহত হবে জাহাজ চলাচল। তবে সমন্বয় করে সেতু নির্মাণের আশ্বাস দেন রেলমন্ত্রী।
চট্টগ্রাম বন্দরের আশপাশে নোঙর করে রাখা হয় পণ্য খালাসে নিয়োজিত শত শত লাইটারেজ জাহাজ।
কিন্তু ঘূর্ণিঝড় কিংবা জলোচ্ছ্বাসের সতর্কতা জারি হলে বন্দরের নিরাপত্তায় জাহাজগুলোকে কর্ণফুলী নদীর উজানে কালুরঘাটের দিকে নিয়ে রাখা হয়।
সম্প্রতি কালুরঘাটে রেল-কাম সড়ক সেতু নির্মাণের ঘোষণার পর জাহাজ চলাচলের সুবিধার্থে সেতুর উচ্চতা বাড়নোর দাবি উঠেছে বিআইডব্লিউটিএ’ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সংস্থার পক্ষ থেকে।
১২.২ মিটার উচ্চতায় হচ্ছে কালুরঘাট সেতু
কালুরঘাট সেতুর উচ্চতা নিয়ে সৃষ্ট জটিলতা কাটল। বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) দাবি অনুযায়ী ১২ দশমিক ২ মিটার উচ্চতায় দক্ষিণ চট্টগ্রামের গুরুত্বপূর্ণ সেতুটি নির্মাণের সিদ্ধান্ত হয়েছে।
যদিও শুরু থেকেই ৭ দশমিক ২ মিটার উচ্চতায় সেতুটি নির্মাণ করতে চেয়েছিল রেলওয়ে।
সূত্র জানায়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সিদ্ধান্তে ১২ দশমিক ২ মিটার উচ্চতায় কালুরঘাট সেতুর নির্মাণ হবে।
যদিও আমরা ৭ দশমিক ২ মিটার উচ্চতায় করতে চেয়েছিলাম।
যেহেতু প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, তাই আমরা ১২ দশমিক ২ মিটার উচ্চতায় সেতুটি তৈরি করব।
১২.২ মিটার উচ্চতায় হচ্ছে কালুরঘাট সেতু, ব্যয় বাড়ছে তিন গুণ
রেলওয়ের সূত্র জানায় জানান, বর্তমান অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে রেল লাইন অ্যালাইনমেন্টে উচ্চতা সর্বোচ্চ ৯ মিটার পর্যন্ত করা যাবে।
কিন্তু বিআইডব্লিউটিএ জানিয়েছে, দুঃসময়ে জাহাজ পারাপারে সেতুটি যাতে কোনো ধরনের প্রতিবন্ধকতা তৈরি না করে সেজন্য সেতুর উচ্চতা বাড়াতে হবে।